ক্রাইম পেট্রোল ডেস্ক।।
সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে বারবার কাটাছেঁড়া করে আসছে ক্ষমতাসীনরা। এক্ষেত্রে আবার আদালতকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধনে জনগণের মতামত কখনোই মূল্য পায়নি সরকারগুলোর কাছে। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে একাধিকবার। আদালতের রায়ের খণ্ডিত অংশকে পুঁজি করে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তুলে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে শেখ হাসিনা সরকার। এতে জনমতের কোনো তোয়াক্কাই করা হয়নি। সেজন্য আগামীতে সংবিধানে কোনো সংশোধনী আনতে সংসদের পাশাপাশি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী গত শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে চূড়ান্ত এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে আরও পাঁচটি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সরকার। তার আগে গত ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করে ছয়টি কমিশন। কমিশনগুলোর এসব প্রতিবেদন ও সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ মাসের মধ্যভাগে এ সংলাপ হতে পারে। এসব বিষয়ে এরই মধ্যে একটি ঐকমত্য কমিশনও গঠন করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কমিশনের প্রধান হিসেবে রয়েছেন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৪৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের ১৪ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘সংবিধান সংশোধনী’ অংশে বলা হয়, ‘সংবিধানের যে কোনো সংশোধনীতে উভয়কক্ষের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয়কক্ষে পাস হলে এটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটের ফলাফল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।’
প্রতিবেদনে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সুপারিশ করেছে কমিশন। আইনসভার নিম্নকক্ষের নাম হবে জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষ হবে সিনেট। জাতীয় সংসদের আসন হবে ৪০০। এর মধ্যে ১০০ জন নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত হবেন। বাকি ৩০০ জন বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ১০ শতাংশ প্রার্থী হবে তরুণ। নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করবে। আর সরকার গঠনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা প্রভাব ফেলবে না বলে উল্লেখ করা হয়।
অন্যদিকে ১০৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে আইনসভার উচ্চকক্ষ। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষে ১০০ জন নির্বাচিত হবেন। অবশিষ্ট ৫টি আসন পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবেন, যারা কোনো কক্ষেরই সদস্য বা রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। সংসদের উভয়কক্ষের মেয়াদই হবে চার বছর।
এছাড়াও সুপারিশে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি জীবনে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না। উভয়কক্ষে ডেপুটি স্পিকারের একটি পদ বিরোধী দল পাবে। নির্বাচনে প্রার্থিতার বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ২১ বছর নির্ধারণের সুপারিশ করেছে কমিশন।
সংবিধান সংস্কারে কেন গণভোট হওয়া উচিত এ বিষয়ে কমিশনের যুক্তি, ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ১৭ বার পরিবর্তন করে একদলীয় ব্যবস্থা কিংবা সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংবিধানের নামে স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধানে রূপ দেওয়া হয়েছে সংবিধানকে। এসব ঠেকাতেই জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে গণভোটের কথা বলা হয়েছে। কারণ, একটি জাতি এই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে, সুতরাং তাদের কাছ থেকে অবশ্যই সংবিধান সংশোধনের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অনুমোদন নিতে হবে।
সংবিধান সংস্কারে গণভোট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিশন প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সংবিধান সংশোধনে আমরা গণভোটের পক্ষে। কারণ, অতীতে জনগণের মতামতকে কোনো ধরনের আমলে না নিয়ে, জনমতকে উপেক্ষা করে শাসকরা নিজেদের ইচ্ছামতো সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছে। ভবিষ্যতে আমরা সেটি আর দেখতে চাই না।’