
ক্রাইম পেট্রোল ডিজিটাল ডেস্ক।।
নাগরিকবান্ধব ডিজিটাল সেবার বিস্তার, সরকারি সেবা ব্যবস্থাপনাকে আরও সুদৃঢ় করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক জনসেবায় উদ্ভাবন, দক্ষতা উন্নয়ন এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে ২০২৫ সাল শেষ করেছে এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলমান এই উদ্যোগটি ২০০৪ সালে ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আইসিটি সক্ষমতা বৃদ্ধি’ প্রকল্প হিসেবে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় এটি ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ নামে পুনর্গঠিত হয়। ২০২০ সালে এর নতুন নাম হয় ‘এসপায়ার টু ইনোভেট’। বিগত বছরগুলোতে এটুআই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে সরকারি সেবা গ্রহণ প্রক্রিয়া আরও সহজ, দ্রুত ও নাগরিক-বান্ধব করেছে। ২০২৫ সালেও এই প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল এবং একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক কাজ আরও জোরদার করা হয়েছে।
এ বছর মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে, তাঁর বিশেষ সহকারীর দিকনির্দেশনা এবং এটুআই-এর কারিগরি সহায়তায় ‘নাগরিক সেবা বাংলাদেশ’ উদ্যোগটি বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যে এক হাজারের বেশি উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং সারাদেশে ৫০০টির বেশি নাগরিক সেবা কেন্দ্র চালু হয়েছে। যার মাধ্যমে শহর থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাগরিকরা সহজেই সরকারি সেবা পাচ্ছেন।
চলতি বছরে বড় অগ্রগতির একটি ছিল একীভূত সেবা গেটওয়ে হিসেবে মাইগভ (myGov) প্ল্যাটফর্মে নতুন ১৬৮টি সেবা যুক্ত এবং প্ল্যাটফর্মের অন্যন্য সেবাগুলো আরও সহজ করা। এতে নাগরিকদের সেবা নেওয়ার আগ্রহ যেমন বেড়েছে, তেমনি আবেদন গ্রহণ থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি আরও সুসংগঠিতভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে দেশের ৬৪টি জেলার সব জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মাইগভের ডিজিটাল কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। বর্তমানে ১১১টি ডিজিটাইজড ফর্মের মাধ্যমে ৩২টি সেবা দেওয়া হচ্ছে এবং ধাপে ধাপে আরও সেবা যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে দৃশ্যমান উন্নয়নের অন্যতম হলো অনলাইনে কাগজপত্র সত্যায়ন সেবা—ই-অ্যাপোস্টিল ।
গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশ হেগ অ্যাপোস্টিল কনভেনশনে যোগ দেওয়ার পর ‘ইন্টিগ্রেটেড অনলাইন অ্যাটেস্টেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’-এর মাধ্যমে এই সেবাটি চালু হয়। এ বছর যা সম্প্রসারিত হয়ে ১৮ লাখের বেশি অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়াকরণ করেছে। এর ফলে সেবা গ্রহণে লাইনে দাঁড়ানো, বিভিন্ন দপ্তরে বারবার যাওয়া ও দালাল নির্ভরতা হ্রাসের পাশাপাশি আনুমানিক ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।
পর্যটন খাতে ডিজিটাল সেবার ব্যবহার বাড়ানোর অংশ হিসেবে ৩০ জুন লালবাগ কেল্লায় এবং ১২ নভেম্বর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে মাইগভ ই-টিকিটিং সেবা চালু করা হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন লক্ষাধিক টিকিট ইস্যু হয়েছে, যার মাধ্যমে সরকারের এক কোটিরও বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। ধাপে ধাপে দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রেও এই সেবা চালু করার বিষযটি প্রক্রিয়াধীন।
সরকারি বিভিন্ন সেবার ফি ও বিল (যেমন বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, শিক্ষা ফি ও সিটি কর্পোরেশন সেবা ইত্যাদি) অনলাইনে সহজে পরিশোধের জন্য সমন্বিত বিল পরিশোধ প্ল্যাটফর্ম ‘একপে’ এর মাধ্যমে এ বছরে প্রায় ৯ শত কোটি টাকারও অধিক লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে এবং ৩২২টি নতুন প্রতিষ্ঠানের ১৮টি নতুন সেবা যুক্ত হয়েছে।
সরকারি তথ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও জনবান্ধব করতে ন্যাশনাল পোর্টাল ফ্রেমওয়ার্ক ২.০ চালু করা হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় তথ্য বাতায়ন প্ল্যাটফর্মে ৫২ হাজার সরকারি দপ্তরের ৩৬ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট উন্নত সংস্করণে রূপান্তরিত হয়েছে এবং বার্ষিক নাগরিক সম্পৃক্ততা ৩০০ কোটি ছাড়িয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এর মাধ্যমে ২৬ লক্ষেরও অধিক কল গ্রহণ করে সরকারি সেবার তথ্যাদি প্রদান করা হয়েছে।
বিচার ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তরে ই-কজলিস্ট, জুডিশিয়াল পোর্টাল, ই-কোর্ট ও মোবাইল কোর্ট কার্যক্রম সম্প্রসারণে এটুআই কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে। এর ফলে অপ্রয়োজনীয় যাতায়াত হ্রাস পেয়েছে এবং মামলা ও আইন সংক্রান্ত তথ্য নাগরিকদের জন্য আরও সহজলভ্য হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি বাড়াতে ডি-নথি এবং রিপোর্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আরএমএস) আরও সমন্বিত করা হয়েছে। ডি-নথিতে প্রায় ১৭ হাজার দপ্তরের ১ লক্ষ ৫৮ হাজারেরও অধিক কর্মকর্তা ১৫ লক্ষাধিক পত্র প্রেরণ করেছেন। এছাড়াও, আরএমএস-এর মাধ্যমে ১৭ হাজারের বেশি সরকারি প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
এছাড়াও ন্যাশনাল ড্যাশবোর্ড, এসডিজি ট্র্যাকার, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ডেটা সিস্টেমের মাধ্যমে তথ্য ও উপাত্তনির্ভর প্রশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ জোরদার করা হয়েছে। এই বছর ৩৩টি দপ্তর-সংস্থার রিয়েল-টাইম ড্যাশবোর্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া, ডেটা লিডারশিপ প্রশিক্ষণ, চাহিদাভিত্তিক বিশ্লেষণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়ন এবং কার্যকর ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে সরকারি পর্যায়ে ডেটা ব্যবহারের সংস্কৃতি আরও সুদৃঢ় হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে বিদ্যমান সিস্টেমসমূহের মধ্যে আন্তঃসংযোগ প্রতিষ্ঠার পদক্ষপে গ্রহণ করা হয়েছে।
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক কার্যক্রমে এটুআই-এর কারিগরি সহায়তায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধিভুক্ত কলেজসমূহে বাধ্যতামূলক আইসিটি কোর্স চালু হয়েছে। ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ‘মুক্তপাঠ’ সরকারি প্রশিক্ষণগুলোকে ডিজিটাল করে সময় ও খরচ কমিয়েছে এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ আরও বাড়িয়েছে। পাশাপাশি নারীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (STEM) বিষয়ে আগ্রহ ও অংশগ্রহণ বাড়াতে ‘She-STEM’ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।
সরকারি সেবাকে আরও জনবান্ধব এবং নাগরিকের চাহিদার প্রতিফলনকে কার্যকর করতে ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ সেবার কেওয়াইসি সম্পন্ন করা হয়েছে, ই-পার্টিসিপেশন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে এবং প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের জন্য নাগরিকবান্ধব সেবা ওয়ার্কবুক প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ডিজিটাল সেবার অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
উদ্ভাবন সংস্কৃতি বিস্তারে জেলা ইনোভেশন চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে কক্সবাজারের ‘ভ্রমণিকা’ ট্রাভেল গাইড অ্যাপের মতো উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে, যেখানে দর্শনীয় স্থান, আবাসন, পরিবহন, আবহাওয়া ও জরুরি সেবাসহ প্রয়োজনীয় তথ্যাদি একই প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এ সেবা দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রেও সম্প্রসারণ করা হবে।
দেশের যাতায়াত ব্যবস্থায় টোল পরিশোধকে আরও দ্রুত ও ঝামেলামুক্ত করতে স্বয়ক্রিয় টোল ব্যবস্থাপনা প্ল্যাটফর্ম ‘ডি-টোল’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সড়ক, সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ের টোল এখন নগদ টাকা ছাড়াই সহজ, দ্রুত ও নিরাপদভাবে দেওয়া যাবে। প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় পদ্মা সেতুতে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে এটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩ হাজার গাড়ি সিস্টেমে নিবন্ধন, দেড় কোটি টাকার লেনদেন এবং ৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এতে যুক্ত হয়েছে।
২০২৬-কে সামনে রেখে সেবার পরিসর বাড়ানো, নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আরও জোরদার করতে এটুআই তাদের বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে সকল সরকারি দপ্তরে আবশ্যিকভাবে ডি-নথি চালুর জন্য প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি, মাইগভ প্ল্যাটফর্মে ৮০টি নতুন ডিজিটাল সেবা সংযোজন, সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য জাতীয় ড্যাশবোর্ড তৈরি, এবং ডি-টোল ইউনিফাইড সিস্টেমের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় টোল ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা হবে। পাশাপাশি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যবই মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকে রূপান্তর, ন্যাশনাল ইনোভেশন রিপোজিটরি ও ন্যাশনাল ইনোভেশন পলিসি প্রণয়নে সহায়তা, সরকারি সেবা উন্নয়নে ডিজিটাল এম্প্যাথি প্রশিক্ষণ, এবং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যায়ক্রমে ইনোভেশন হাব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় উদ্ভাবন ইকোসিস্টেম ও জনবান্ধব সরকারি সেবা ব্যবস্থাকে উন্নততর করে গড়ে তোলার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যেই এটুআই তার কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে।
















