সম্পাদকীয় :
বেসরকারি স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। গত ১২ অক্টোবর ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়ার প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। সারা দেশে থেকে অসংখ্য শিক্ষক-কর্মচারী জড়ো হন প্রেস ক্লাবে। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল।
শিক্ষকদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে পুলিশের মধ্যস্থতায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের শীর্ষ দুই নেতা। তবে প্রজ্ঞাপন জারির ঘোষণা না পাওয়ায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। আন্দোলনের স্থান প্রেস ক্লাবের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ঘোষণা করা হয়। তবে শিক্ষকদের একটি অংশ শহীদ মিনারের পরিবর্তে প্রেস ক্লাবের সামনেই অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। বাধ সাজে পুলিশ।
প্রেস ক্লাব থেকে শিক্ষকদের সরিয়ে দিয়ে সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান নিক্ষেপ থেকে শুরু করে করা হয় লাঠিচার্জ। আহত হন বেশ কয়েকজন। গ্রেপ্তার করা হয় ৫ শিক্ষককে। যদিও রাতে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে শহীদ মিনারেই অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা।
এদিকে আজ সোমবার রাতের মধ্যে ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়ার প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা। এই সময়ের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি না হলে আগামীকাল মঙ্গলবার সচিবালয় অভিমুখে লং মার্চ করবেন তারা।
দেশের ১৮ কোটি মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণ, শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি- বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের স্বার্থেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসাভাতা, উৎসব ভাতা বৃদ্ধি এবং এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতন গ্রেডের বৈষম্য দূর করা জরুরি। সেইসঙ্গে সরকারের দ্রুতগতিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা পত্রের অনুচ্ছেদ ২৩(২) -এ বলা হয়েছে- কোনরূপ বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য প্রত্যেকের সমান বেতন পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(খ) এ বলা হয়েছে-কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার।
অনুচ্ছেদ ২০(১) এ বলা হয়েছে-কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয় এবং “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী” এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।
অনুচ্ছেদ ১৫(ক) এ বলা হয়েছে-অন্ন , বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষাও চিকিৎসাসহ জীবন ধারনের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;
অনুচ্ছেদ ১৭(ক) এ বলা হয়েছে-রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য;
(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রনোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য;
(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকের মধ্যে আর্থিক বৈষম্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় , একজন সরকারি শিক্ষক মূল বেতনের ৪০% থেকে ৫০% বাড়ি ভাড়া, মূল বেতনের সমপরিমাণ উৎসব ভাতা ১ হাজার ৫শ’ টাকা চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকেন। এছাড়াও রয়েছে বদলি ও পদোন্নতিসহ সব ধরনের সুবিধা।এ যেন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকের মধ্যে পাহাড়সম বৈষম্য। বর্তমানে ১ হাজার টাকায় কিচেন রুমে থাকার সুযোগও নেই।২৫% উৎসব ভাতায় ২৫% উৎসব পালনই সম্ভব। এর বেশি আশা করা যায় না। ৫শ’ টাকা চিকিৎসা ভাতাও নগণ্য।
এতে দেখা যায়, একজন বেসরকারি শিক্ষক সামাজকিতা রক্ষা করতেও ব্যর্থ হন।পরিবার -পরিজনের ন্যূনতম চাহিদাটুকুও পূরণ করতে না পারায় তাকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। অথচ বেসরকারি শিক্ষকরা সরকারি শিক্ষকদের সমযোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে সমপরিমাণ কাজ করলেও আর্থিকভাবে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এটা চলতে পারে না। তাছাড়া দেশের প্রায় ৯৭ ভাগ শিক্ষকই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত । এসব প্রতিষ্ঠানে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। আর বাকি ৩ ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও আসন থাকে সীমিত। সে কারণে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে অতি মেধাবী স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে। অবশিষ্ট স্বল্পমেধাসম্পন্ন ও প্রায় মেধাশূন্য শিক্ষার্থীদের ঠাঁই হয় দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া শিক্ষার্থীদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মহান দায়িত্বটুকু গ্রহণ করেন দেশের অবহেলিত বেসরকারি শিক্ষক সমাজ।
ফলে, এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের জন্য যুগ যুগ ধরে শিক্ষক-কর্মচারীরা সংবাদ সম্মেলন, স্মারকলিপি প্রদান ও বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে বিগত সরকারের কাছে দাবি করে আসলেও তাদের সেই দাবি স্বাধীনতার ৫২ বছরেও কোনো সরকারের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকার টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থেকেও শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত ও যৌক্তিক দাবিটি পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। সেকারণে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি,২০২৩ খ্রি. এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোটের আহ্বানে সারাদেশ থেকে আগত হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে টানা ৪৪ দিন আন্দোলনে থাকার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার সাড়া না পেয়ে আন্দোলন স্থগিত করেন মহাজোট নেতৃবৃন্দ।
গত ১১ জুলাই ২০২৩ খ্রি. থেকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি(বিটিএ) এর আহ্বানে আবারও এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষে লাগাতার আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষকরা। সেসময় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোটসহ দেশের প্রায় সবগুলো সমমনা শিক্ষক সংগঠন বিটিএ এর কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করে। ফলে সারাদেশ থেকে লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়মিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো সারা পান নি শিক্ষকরা।
বেসরকারি শিক্ষকদের অবহেলিত রেখে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই আমরা মনে করি, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে জাতীয়করণ করা হলে সরকারের খরচও তেমন হবে না। শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে এদেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ, দূরীভূত হবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য, উজ্জ্বল হবে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি এবং ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে বর্তমান সরকারের অবদান। তাই শিক্ষার মানোন্নয়ন জনস্বার্থ ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিগুলো দ্রুত মেনে নিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট আমরা জোর দাবি জানাই।

















