
মো. সাইফুল্লাহ খাঁন, জেলাপ্রতিনিধি, রংপুর:
ঐতিহাসিক ২৮ মার্চ রংপুরবাসীর কাছে অবিস্মরণীয় দিন। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র একদিন পরই রংপুরবাসী ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল সে পথ ধরেই সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম। স্বাধীনতাপ্রিয় প্রতিবাদী রংপুরবাসী একাত্তরের এই দিনে লাঠি-সোটা, তীর-ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে জন্ম দিয়েছিল এক অনন্য ইতিহাসের।
একাত্তরের ৩ মার্চ। মিছিল আর শ্লোগনে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল গোটা রংপুর। প্রতিবাদমুখর মানুষের মিছিলে নির্বিচারে চালানো হয় গুলি। শহিদ হন কিশোর শংকুসহ আরো তিনজন। রংপুরাঞ্চলে তারাই স্বাধীনতার প্রথম শহিদ। তাদের রক্তদানের মাধ্যমে উত্তাল হয়ে ওঠে রংপুর। স্বাধীনতাকামী মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। প্রস্তুতি গ্রহণ করে সশস্ত্র সংগ্রামের। এরই অংশ হিসেবে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও এর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্বাধীনতাকামী মানুষ। দিনক্ষণ ঠিক হয় ২৮ মার্চ। ঘেরাও অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রংপুরের বিভিন্ন হাটে-বাজারে ঢোল পিটানো হয়। আর এ আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে। সাজ সাজ রব পড়ে যায় চারিদিকে। যার যা আছে তাই নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয় এ অঞ্চলের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছাত্র, কৃষক, দিনমজুরসহ সকল পেশার সংগ্রামী মানুষ।
রংপুরের আদিবাসীরাও তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ ক্ষেত্রে মিঠাপুকুর উপজেলার ওরাঁও সম্প্রদায়ের তীরন্দাজ সাঁওতালদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তীর-ধনুক, বল্লম, দা, বর্শা নিয়ে তারা যোগ দিয়েছিল ঘেরাও অভিযানে।
২৮ মার্চ রবিবার সকাল থেকে রংপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। সময় যত এগিয়ে আসে উত্তাপ আর উত্তেজনা ততই বাড়তে থাকে। সকাল ১১টা বাজতে না বাজতেই সাজ সাজ রব পড়ে যায় চারিদিকে। জেলার মিঠাপুকুর, বলদীপুকুর, মানজাই, রানীপুকুর, তামপাট, পালিচড়া, বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, গণেশপুর, দামোদরপুর, পাগলাপীর, সাহেবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারো মানুষ একত্রিত হতে থাকে। সবার হাতে ছিল লাঠি-সোটা, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লম, দা ও কুড়াল।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সে সময় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ২৯ ক্যাভেলরি রেজিমেন্টের মেজর নাসির উদ্দিন তার যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা গ্রন্থে সে দিনের বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন, যে দৃশ্য আমি দেখলাম তা চমকে যাবার মতোই। দক্ষিণ দিক থেকে হাজারো মানুষ সারি বেঁধে এগিয়ে আসছে সেনা ছাউনির দিকে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই দা-কাঁচি, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লমের মতো অতি সাধারণ সব অস্ত্র। বেশ বোঝা যাচ্ছিল এরা সবাই স্থানীয়। সারি বাঁধা মানুষ পিঁপড়ের মতো ক্রমেই এগিয়ে আসছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোটা দশেক জিপ বেরিয়ে আসে এবং মিছিল লক্ষ্য করে শুরু হয় একটানা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ। মাত্র ৫ মিনিটে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। হাজারো লাশ পড়ে থাকে মাঠে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে টেনে-হেঁচড়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করা হলো পুড়িয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু তখনো যারা বেঁচে ছিল তাদের গোঙানিতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল পাঞ্জাবি জান্তারা। এ অবস্থাকে আয়ত্বে আনার জন্যে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে চিরতরে তাদের থামিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল তারা। আহতদের আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
তার বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে, সেদিন সন্ধ্যার আগেই নির্দেশমতো ৫ থেকে ৬ শ মৃতদেহ পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। এ আগুন অন্য যেকোনো আগুনের চেয়ে অনেক বেশি লাল। অনেক বেশি দহন করে এই বহ্নিশিখা। আমি খুব কাছ থেকেই আগুন দেখছি কেমন করে জ্বলছে স্বাধীনতাপ্রিয় অসহায় মানবসন্তান।
এ ব্যাপারে রংপুর মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সদরুল আলম দুলু জানান, মূলত রংপুরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ৩ মার্চ। ওই দিন বঙ্গবন্ধু সারা দেশে হরতাল ডাকেন। হরতাল সফল করতে দলমত নির্বিশেষে সবাই শহরের জিরো পয়েন্ট কাচারিবাজারে জমায়েত হন। তখনো অল্পসংখ্যক মানুষ। কিন্তু মিছিলটি বের হওয়ার পরই আস্তে আস্তে তা রূপ নেয় বিশাল মিছিলে। সেই মিছিলে ছিলেন রফিকুল ইসলাম গোলাপ, মমতাজ জাকির আহমেদ সাবু, সিদ্দিক হোসেন, শেখ আমজাদ হোসেন, ইছাহাক চৌধুরী, হারেস উদ্দিন সরকার, নুরুল হক, মুকুল মোস্তাফিজ, অলক সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, আবুল মনসুর আহমেদ, খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল, তৈয়বুর রহমান বাবু, মুসলিম উদ্দিন কমিশনার, মাহবুবুল বারী, জায়েদুল আলম, মোফাজ্জল হোসেনসহ হাজারো বীর জনতা।
মিছিলটি তৎকালীন তেঁতুলতলায় (বর্তমান শাপলা চত্বর) পৌঁছলে সেখানে শহিদ মুখতার ইলাহী, রনী রহমান ও জিয়াউল হক সেবুর নেতৃত্বে কারমাইকেল কলেজ থেকে আরেকটি মিছিল যোগ দেয়। সেদিনের ওই মিছিল রংপুর রেলস্টেশন হয়ে ফিরে আসার পথে বর্তমান ঘোড়াপীর মাজারের সামনের তৎকালীন অবাঙালি সরফরাজ খানের বাসার ওপর উর্দুতে লেখা একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে মিছিলকারীদের। তাৎক্ষণিক ওই সাইনবোর্ড নামাতে এগিয়ে যান মিছিলকারী সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শংকু সমাজদার, মকবুল হোসেন, শফিকুলসহ অনেকেই। আর ঠিক তখনই ওই বাসা থেকে চালানো হয় গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন শংকু ও তৎকালীন কারমাইকেল কলেজের ছাত্রলীগকর্মী শফিকুল।
সহযোদ্ধারা আহত শংকু ও শফিকুলকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু পথেই ১২ বছরের বিপ্লবী কিশোর শংকু মৃত্যুবরণ করেন। সেদিনই রংপুরের প্রথম শহিদ হওয়ার গৌরব অর্জিত হয় ছোট্ট ছেলে শংকুর। আর দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় চিকিৎসাধীন থেকে মারা যান শফিকুল।
সদরুল আলম দুলু জানান, শংকুর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে এক ভয়াল শহরে রূপ নেয় রংপুর। উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে ওঠে শহরে। বাঙালিদের ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে থাকে অবাঙালিদের বাড়ি-ঘর, দোকান ও প্রতিষ্ঠান। মূলত সেদিনের সেই ঘটনার মধ্য দিয়েই রংপুরে সূচনা হয় মুক্তিযুদ্ধের। এরপর আসে ভয়াল ২৫ মার্চ। ওই দিন দুপুরের পরপরই শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে অপহরণ করা হয় শান্তি চাকী, খুররম, মহররম, জররেজ, দুলাল, গোপাল চন্দ্র, উত্তম কুমার অধিকারী, সতীশ হাওলাদার, দুর্গা দাসসহ ১১ জনকে। এরপর ৩ এপ্রিল দখিগঞ্জ শ্মশানে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৮ মার্চ রংপুরের মানুষ জেগে উঠেছিল এক নবচেতনায়। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চল হতে লাঠি-সোটা, তীর-ধনুক, বল্লম নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাঁশের লাঠি আর তীর-ধনুক নিয়ে পাকিস্তানি হায়েনাদের আবাসস্থল ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। এমনি এক ঘটনাই সেদিন ঘটিয়েছিলেন রংপুরের বীর জনতা।
স্বাধীনতাকামী রংপুরের মানুষ ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের মধ্য দিয়ে শুরু করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। ২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে এটাই তাদের মুখোমুখি প্রথম যুদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেদিনের সেই ত্যাগের স্বীকৃতি জাতীয়ভাবে আজও মেলেনি।
তবে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও অভিযানে যেখানে আত্মত্যাগী মানুষগুলো শেষবারের মতো একত্রিত হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক নিসবেতগঞ্জ এলাকায় ২০০৩ সালে রক্ত গৌরব নামে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ যা আজও নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
প্রতিবছর এই দিনে স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পালিত হয় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। আজ ঐতিহাসিক ২৮ মার্চ, শহীদদের স্মরণে নগরীর নিসবেতগঞ্জ হাটের পাশে নির্মিত ‘রক্ত গৌরব’ স্মৃতিস্তম্ভে দিবসটি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সকাল থেকেই সকল রাজনৈতিক দলসহ সহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন সংগঠন ও স্থানীয় এলাকাবাসী সেখানে শ্রদ্ধা জানান।