সম্পাদকীয় :
৫৪ বছর ধরে দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মাঝে বিরাজমান বৈষম্য দূরীকরণ করে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণ, শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থেই এমপিওভুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা জরুরি। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা পত্রের অনুচ্ছেদ ২৩(২) -এ বলা হয়েছে- কোনরূপ বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য প্রত্যেকের সমান বেতন পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(খ) এ বলা হয়েছে-কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার।
অনুচ্ছেদ ২০(১) এ বলা হয়েছে-কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয় এবং “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী” এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকের মধ্যে আর্থিক বৈষম্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় , একজন সরকারি শিক্ষক মূল বেতনের ৪০% থেকে ৫০% বাড়ি ভাড়া, মূল বেতনের সমপরিমান উৎসব ভাতা ১ হাজার ৫শ’ টাকা চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকেন। এছাড়াও রয়েছে বদলি ও পদোন্নতিসহ সব ধরনের সুবিধা।এ যেন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকের মধ্যে পাহাড়সম বৈষম্য। বর্তমানে ১ হাজার টাকায় কিচেন রুমে থাকার সুযোগও নেই।২৫% উৎসব ভাতায় ২৫% উৎসব পালনই সম্ভব। এর বেশি আশা করা যায় না।৫শ’ টাকা চিকিৎসা ভাতাও নগণ্য।
এতে দেখা যায়, একজন বেসরকারি শিক্ষক সামাজকিতা রক্ষা করতেও ব্যর্থ হন।পরিবার -পরিজনের ন্যূনতম চাহিদাটুকুও পূরণ করতে না পারায় তাকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়।অথচ বেসরকারি শিক্ষকরা সরকারি শিক্ষকদের সমযোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে সমপরিমাণ কাজ করলেও আর্থিকভাবে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এটা চলতে পারে না। তাছাড়া দেশের প্রায় ৯৭ ভাগ শিক্ষকই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত । এসব প্রতিষ্ঠানে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। আর বাকি ৩ ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও আসন থাকে সীমিত। সে কারণে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে অতি মেধাবী স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে। অবশিষ্ট স্বল্পমেধাসম্পন্ন ও প্রায় মেধাশূন্য শিক্ষার্থীদের ঠাঁই হয় দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া শিক্ষার্থীদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মহান দায়িত্বটুকু গ্রহণ করেন দেশের অবহেলিত বেসরকারি শিক্ষক সমাজ।
ফলে, এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের জন্য যুগ যুগ ধরে শিক্ষক-কর্মচারীরা সংবাদ সম্মেলন, স্মারকলিপি প্রদান ও বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে বিগত সরকারের কাছে দাবি করে আসলেও তাদের সেই দাবি স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও কোনো সরকারের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকার টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থেকেও শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত ও যৌক্তিক দাবিটি পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। সেকারণে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি,২০২৩ খ্রি. এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোটের আহ্বানে সারাদেশ থেকে আগত হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে টানা ৪৪ দিন আন্দোলনে থাকার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার সাড়া না পেয়ে আন্দোলন স্থগিত করেন মহাজোট নেতৃবৃন্দ।
গত ১১ জুলাই ২০২৩ খ্রি. থেকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি(বিটিএ) এর আহ্বানে আবারও এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষে লাগাতার আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষকরা। সেসময় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোটসহ দেশের প্রায় সবগুলো সমমনা শিক্ষক সংগঠন বিটিএ এর কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করে। ফলে সারাদেশ থেকে লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়মিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো সারা না পাওয়ায় দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তালা ঝুলানোর কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিটিএ এর নেতৃবৃন্দ।এ ঘোষণার পর থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঝুলানো হয় তালা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান চাকরি হারানোর ভয়ে খোলা রাখলে ঠিকমতো ক্লাস নেননি তারা।
এরই মধ্যে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি আন্দোলনরত ও আন্দোলনবিহীন শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনায় বসলেও তা ফলপ্রসূ হয় নি। কারণ যারা আন্দোলন করেনি তাদেরকেও বৈঠকে ডাকা হয় এবং তাদেরকে প্রাধান্য দেয়া হয়। অপরদিকে, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের আসন ব্যবস্থা এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর কথাবার্তায় শিক্ষক নেতৃবৃন্দকে অপমানিত করা হয় বলে শিক্ষক নেতারা দাবি করেন।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের বিষয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন যা শিক্ষক সমাজের জন্য মানহানিকর। শিক্ষক নেতারা বলেন, সরকার নির্ধারিত যোগ্যতার ভিত্তিতেই সরকারি এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ সম্পন্ন হয়। এখানে শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক নয়। তিনি শিক্ষকদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছিলেন।
বেসরকারি শিক্ষকদের অবহেলিত রেখে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই আমরা মনে করি, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে জাতীয়করণ করা হলে সরকারের খরচও তেমন হবে না। শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে এদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষ, দূরীভূত হবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য, উজ্জ্বল হবে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি এবং ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে বর্তমান সরকারের অবদান। তাই শিক্ষার মানোন্নয়ন জনস্বার্থ ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠায় এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট আমরা জোর দাবি জানাই।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয় করতে সরকারের কোনো অতিরিক্ত অর্থ লাগবেনা।নিম্ন এর একটি হিসাব তুলে ধরা হলো:
কলেজের সংখ্যা: ৪,০০৭ টি,মাধ্যমিক: ১৯,৮৪৮টি, মাদ্রাসা: ৯,৩৪১ টি। মোট এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান-৩৯,০৯২ টি।
শিক্ষকের সংখ্যা:
কলেজ: ১,১৭,৩৩৭ জন, মাধ্যমিক-২,৪৩,৫৫৩ জন,মাদ্রাসা-১,১৩,৩৬৮ জন, এবং কারিগরি-৩২,৩৭৮ জন।
ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা:
কলেজ-৩৭,৬৭,৭৮৪ জন,মাধ্যমিক-৯১,৬০,৩৬৫ জন,মাদ্রাসা-২৪,৬০,৩০৫ জন,কারিগরি-৮,৭৫,২৭০ জন
মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা- ১,৬২,৬৩,৭২৪ জন
প্রতি শিক্ষার্থী মাসিক ২০ টাকা হারে বেতন দিলে বার্ষিক আয় হবে(১৬২৬৩৭২৪*২০*১২)= ৩৯০ কোটি টাকা।
ভর্তি ফি/ সেশন ফি শিক্ষার্থী প্রতি গড়ে ৪০০/- টাকা করে নিলে মোট আয় হবে( ১,৬২,৬৩,৭২৪*৪০০)=৬৫০ কোটি টাকা।
অন্যান্য আয়: প্রতি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয় গড়ে ৫০ হাজার টাকা ধরা হলে মোট আয় হবে(৩৯,০৯২*৫০,০০০)= ২০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে এমপিও খাতে সরকারের বার্ষিক ব্যয় হচ্ছে ১,৪২৫ কোটি টাকা। আর জাতীয়করণ করলে প্রয়োজন হবে ২,৫০০ কোটি টাকা।
সরকারের বার্ষিক আয় হবে(১,৪২৫+৩৯০+৬৫০+২০০)= ২,৬৬৫ কোটি টাকা( বর্তমান এমপিও’র জন্য প্রদত্ত অর্থসহ)। সরকারের বার্ষিক উদ্বৃত্ত থাকবে(২,৬৬৫-২,৫০০)=১৬৫ কোটি টাকা। তাহলে জাতীয়করণে বাধা কোথায়?
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি: প্রফেসর নূর মো. রহমত উল্লাহ। নির্বাহী সম্পাদকঃ ব্যারিস্টার মো. ইমরান খাঁন, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মো. ওমর ফারুক
ইমেইল: [email protected] মোবাইল: ০১৭৫৪-২২২৫০২
অফিসঃ গ্রামঃ শ্রীমদ্দি(আলোনিয়াকান্দি), পোঃ- হোমনা, উপজেলাঃহোমনা, জেলাঃ কুমিল্লা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. ইব্রাহিম খলিল কর্তৃক কুমিল্লা জেলা থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত।