আনিছুর রহমান মানিক, ডোমার (নীলফামারী) প্রতিনিধি>>
নীলফামারীর ডোমারে নির্যাতিতা অসহায় নারী জীবনের সাথে যুদ্ধ করে সফল আত্মকর্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন যিনি। তারই জীবনের গল্প তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র।
উপজেলার পশ্চিম বোড়াগাড়ী ইউনিয়নের সবুজপাড়া গ্রামের দিন মুজুর শামসুল আলমের প্রথম কন্যা ছামিনা আক্তার (৩৯) মাতা হামিদা বানু। তাদের কোল জুড়ে পৃথিবীতে আসে বিগত ৯ ডিসেম্বর ১৯৮১ সালে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে লেখাপড়ায় মনোযোগও ছিল বেশ ভাল। প্রাইমারীর গন্ডি পেরিয়ে বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় ছামিনা। কিন্ত বাঁধ সাধে নিয়তি, তারা ৪ ভাইবোন লেখাপড়া করাতে পারছিল না তার গরিব পিতা। ৮ম শ্রেণিতে উঠেই হঠাৎ ছমিনার বিয়ে হয় পাশের গ্রামের এক হোটেল শ্রমিক চাঁদ মিয়ার সাথে। ১০ বছর সংসার জীবনে ছামিনা ২ সন্তানের জননী হয়। স্বামী চাঁদ মিয়া পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ায় সংসারে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া। স্বামী ব্যবসা করার জন্য ছামিনার বাবার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আনতে বলে, নইলে ২য় বিয়ে করবে বলে হুমকি দেয়। যার কারণে শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ছামিনার বাবা জামাই চাঁন মিয়ার চাহিদা মতে টাকা দিতে না দেয়ায় নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় পাষণ্ড স্বামী। বেশ কিছুদিনের মধ্যে চাঁদ মিয়া আবারো ২য় বিয়ে করে নতুন বউ বাড়িতে এনে ছামিনাকে জোরপূর্বক মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ২০০৫ সালে ১০এপ্রিল ছামিনা স্বামী পরিত্যক্তা হয়। সেই থেকে গরিব বাবার সংসারে ২ সন্তান নিয়ে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তার জীবনের কষ্টের গল্প শুনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। তৎকালীন উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা একেএম জিয়াবুল আলমের মাধ্যমে ছামিনাকে ৪ মাস মেয়াদী সেলাই, বাটিক, হ্যান্ড এম্ব্রয়ডারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে নিজ বাড়িতে এসে এলাকার অসহায় ও বেকার যুব মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নারীদের স্বাবলম্বী করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে এবং প্রচেষ্টা যুব মহিলা উন্নয়ন সমিতি গঠন করে যাহার নিবন্ধন নং-যুউঅ/নীল-১১/২০১৭। সমিতি কার্যক্রম থেকে অন্যান্য অসহায় নারীসহ নিজের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আনে। পরে তিনি ডোমার উপজেলা পরিষদ মার্কেটে ২টি দোকান ঘর ভাড়া নেন, যার নাম রেখেছে আল-আমিন টেইলার্স এন্ড ক্লোথ স্টোর। সেখানে ৬টি সেলাই মেশিন কিনে ২০ জন হতদরিদ্র নারীকে কাজে লাগিয়ে মহিলাদের থ্রি-পিছ, শাড়িসহ বিভিন্ন কাপড় বিক্রি করতো এবং সেলাই, বøক বাটিক, হ্যান্ড এম্ব্রয়ডারী কাজ করে তা বাজারজাত করেন তারা। বর্তমানে ছামিনার মাসিক আয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। সেই থেকে আবারো তিনি লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠে। ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২০১২ সালে এসএসসি ও ২০১৫ সালে এইচএসসি সফলতার সাথে পাশ করেন। বর্তমানে বিএ ৪র্থ বর্ষে অধ্যায়নরত আছেন। তবে করোনা মহামারির কারণে কলেজ বন্ধ থাকায় মাস্টার্স পাশ করতে পারেনি ছামিনা। তার বড় ছেলে আল-আমিন বিএ অনার্স শেষ করেছে এবং ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। ছামিনা আক্তার তার নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে শতশত বেকার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বেকারত্ব দূরীকরণে এলাকায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই সফল আত্মকর্মী নারী। তার এই সাফল্যের জন্য নারী জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় বেগম রোকেয়াকে আদর্শ মেনে “নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী” ক্যাটাগরির আওতায় আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে “জয়িতা অন্বেষণে” জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ২০১৮ সালে ২ বার শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পান। উপজেলা পর্যায়ে ২০২০ সালে এবং আবারো ২০১৮ সালে রংপুর বিভাগে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে সম্মাননা স্মারক পেয়ে এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেন ছামিনা আক্তার। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকার হাজারো অসহায় নারী নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। নারীরা সমাজের বোঝা নয়, তাকে দেখে আমাদের সমাজের নির্যাতিত ও অবহেলিত নারীদের শিক্ষা নেয়া উচিত বলে মনে করেন সফল আত্মকর্মী ছামিনা আক্তার।