
জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহঃ
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ খাদ্যগুদামে মহাজালিয়াতির ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ৯০ জন অস্তিত্বহীন কৃষকের নামে ধান সরবরাহ করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে ওই নামে কোন কৃষক পাওয়া যায় নি। অভিযোগ উঠেছে কালীগঞ্জ খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম ও অগ্রনী ব্যাংকের ম্যানেজার শৈলেন কুমার বিশ্বাসের জোগসাজসে এই জালিয়াতি কর্ম সম্পাদন করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে কালীগঞ্জ উপজেলার পার শ্রীরামপুর গ্রামে লুৎফর রহমান, আব্দুল কাদের, আব্দুল মান্নান, নুরুল হুদা, কাশেম ফকির নামের মানুষগুলোর কাছ থেকে ধান কেনা হয়েছে। কিন্তু ওই গ্রামে এই নামের কোন অস্তিত্ব মেলেনি। এ ভাবে প্রায় ৯০ জনের কাছ থেকে সরকারিভাবে ধান কেনা হয়েছে। বিধি ভঙ্গ করে পার শ্রীরামপুর গ্রামের ১৩১ জন কৃষকের নামে ধান বিক্রির কার্ড বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। গ্রামবাসী বলছেন, এই নামগুলোর মানুষ তাদের গ্রামের নেই। ২/৪ জনের নাম মিললেও পিতার নামের সাথে কোন মিল নেই। অথচ অস্তিত্বহীন এই মানুষগুলো এবার সরকারি গুদামে উচ্চমূল্যে ধান বিক্রি করেছেন। তাদের নামে জাতীয় পরিচয়পত্র, কৃষক কার্ড এমনকি ব্যাংক একাউন্ট পর্যন্ত খোলা হয়েছে। গুদাম থেকে তাদের ধান বিক্রির মূল্য হিসেবে টাকাও পরিশোধ করা হয়েছে। গ্রামবাসীর ভাষ্য, এটা চরম দুর্নীতি। তাদের বঞ্চিত করে সরকারি মূল্যে অস্তিত্বহীন মানুষের নামে গুদামে ধান বিক্রি করা হয়েছে। লটারীর মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন না করে দুর্নীতিবাজরা লাখ লাখ টাকা নিয়েছেন। আর এই ধান কেনার টাকা খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ, কৃষি বিভাগ ও ব্যাংক কর্মকর্তারা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বলেও অবিযোগ।
জেলা খাদ্য বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, এ বছর কালীগঞ্জ উপজেলায় ৪ হাজার ১৯৮ জন কৃষকের নিকট থেকে ২০১৮ মেঃ টন ধান কেনা হয়েছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র ৬ নম্বর ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে ৩৭৫ জন কৃষকের নিকট থেকে ১৮০ মেঃ টন ধান কেনা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এক ইউনিয়নে এতো কৃষকের নাম কীভাবে উঠলো ?
ওই গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, লাটারীর মাধ্যমে যে তালিকা করা হয়েছে সেই তালিকার ১৩১ জনের মধ্যে ৯০ জনের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। নামগুলো ধরে ধরে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এই নামে তাদের গ্রামে কেও নেই। নান্টুর পুত্র সেকেন্দার আলী, কওছারের পুত্র আব্দুল মান্নান, ইছাহক আলীর পুত্র আব্দুর রহমান, আব্দুল মালেকের পুত্র রবজেল হোসেন, আনছার মন্ডলের পুত্র আজিবর রহমানসহ অসংখ্য নামের কোনো মানুষ খুজে পাওয়া যায়নি।
গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম জানান, তারা নামগুলো শুনে কিছুটা আশ্চর্য হচ্ছেন। কারা এই ভুয়া নামে ধান বিক্রি করলেন তা তদন্ত হওয়া দরকার।
এদিকে কৃষি বিভাগে খোজ নিয়ে দেখা গেছে এই গ্রামে ১২১ জন কৃষকের কৃষি কার্ড রয়েছে। যাদের মধ্যে ওই ৯০ জনের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া যে ১২১ টি কৃষক কার্ড রয়েছে তার নাম্বার ৪৪৩৩০৬১৮০১০৭৪ থেকে ৪৪৩৩০৬১৮০১১৯৪ পর্যন্ত। অথচ ধান ক্রয়ের তালিকায় মাত্র ২২ জনের নাম রয়েছে যাদের কার্ড নাম্বার দেওয়া হয়েছে হাজারের উপরের সংখ্যা, বাকিগুলো সবই হাজারের নিচে। এমনকি ০০৩০, ০০৪২, ০০৪৩ সহ একাধিক কার্ড একাধিক কৃষকের নামে দেখানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ওই ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান জানান, তালিকা করার সময় দ্রুত করায় যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তালিকা তার সামনে দিয়ে স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছিল, তিনি স্বাক্ষর করেছেন। তালিকার সঙ্গে কৃষক কার্ডের মিল না থাকা প্রসঙ্গে তিনি জানান, নামের মিল না থকেল কার্ড নাম্বারের মিল কীভাবে থাকবে।
এ বিষয়ে অগ্রনী ব্যাংক শাখার ব্যাবস্থাপক শৈলেন কুমার বিশ্বাস জানান, তারা একাউন্ট করার সময় কাগজপত্র নিয়েছেন। কেউ ভুয়া কাগজ দিলো কিনা সেটা খাতিয়ে দেখবেন।
কালীগঞ্জ খাদ্য বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, যখন কৃষকরা ধান বিক্রি করতে এসেছিলেন তখন প্রচন্ড ভীড় ছিল। যে কারণে অনেক কিছু দেখা সম্ভব হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবর্ণা রাণী সাহা জানান, বিষয়টি তদন্ত করার জন্য তিনি উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তাজউদ্দিন আহম্মেদকে দায়িত্ব দিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে ওই ইউনিয়নের কালুখালী, মধুপুর ও সাহাপুর গ্রামের একাধিক কৃষকের নামে ধান বিক্রি হয়েছে। যাদের সঙ্গে কথা বললে তারা এর কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন।